জেলা প্রতিনিধি, সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের চান্দাইকোনায় পরিবেশ আইনের তোয়াক্কা না করে আবাসিক এলাকা ও তিন ফসলি জমিতে গড়ে উঠছে অটো রাইস মিল। এতে ওই এলাকার পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে। অটো রাইস মিলটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়াসহ এর মালিকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দাসহ পার্শ্ববর্তী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা।
বগুড়া-নগরবাড়ী মহাসড়কের চান্দাইকোনা মৌজায় (খতিয়ান নং-১৬ ও ২২৩, দাগ নং-১৮১৮ ও ১৮২৪) ৫৭ শতক ফসলি জমিতে অপরিকল্পিতভাবে বিসমিল্লাহ অটো রাইস মিল স্থাপনের কাজ চলছে। এটি চালু হলে মিলের বর্জ্যে ফসলি জমিসহ এলাকার পরিবেশ নষ্ট হবে।
অটো রাইস মিলের ধোঁয়া ও ছাইয়ে বয়স্ক মানুষ ও শিশুদের শ্বাসকষ্ট হবে। কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা আছে। পাশে অবস্থিত চান্দাইকোনা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হবে। এ কারণে মিলটি বন্ধের দাবি জানিয়ে জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন এস এম সোহাগ নামের এক স্থানীয় কৃষক।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, চান্দাইকোনা বাজারের পাশে জনবসতি এলাকায় তিন ফসলি জমিতে রিয়া নামে অটো মিল গড়ে তোলা হয়েছে। এই অটো মিলের অন্তরালে আনোরুল ইসলাম গং আরেকটি অটো রাইস মিল স্থাপন করছে।
এ মিল চালু হলে এর বর্জ্যমিশ্রিত দুর্গন্ধযুক্ত পানি, কালো ধোঁয়া ও ছাই পার্শ্ববর্তী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, ইউনিয়ন পরিষদ ও পল্লীবিদ্যুৎ সাব-স্টেশনসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করবে। শিক্ষার্থীসহ স্থানীয় জনসাধারণকে দুর্ভোগ পোহাতে হবে। সেই সঙ্গে নষ্ট হবে তিন ফসলি জমি। নষ্ট হবে স্থানীয় ঘর-বাড়ি, গাছপালা।
অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা দুটি অটো রাইস মিল বন্ধসহ আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জোর দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় জমির মালিক এস এম সোহাগ, আব্দুর রাজ্জাক শেখ, নিজাম উদ্দিন আকন্দ, জহুরুল ইসলাম আকন্দ, মামুন আকন্দ, আবু ওয়াহেদ সোহেল সরকার, আবু হাসেম, দুলাল শেখসহ বেশ কয়েকজন।
শনিবার (১৮ নভেম্বর) সকালে সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, রায়গঞ্জ উপজেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে ১৫০টি চালকল ও অটো রাইস মিল আছে। এর মধ্যে পরিবেশের ছাড়পত্র আছে মাত্র দুটির। বাকি চালকলগুলো অবাধে চলছে।
এতে ফসলি জমি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আবাসিক অঞ্চলে স্থাপনের কারণে পরিবেশের ছাড়পত্র পায়নি অধিকাংশ চালকল। পরিবেশের ছাড়পত্র ও অনুমোদন ছাড়াই দাপটের সঙ্গে চলছে এসব চালকল। এসব চালকল পরিবেশের নিয়মনীতি মেনে স্থাপন করা হয়নি। এ কারণে কারখানার গরম পানি, ছাই ও দুষিত বর্জ্যে আবাদি জমি ও নদী দূষিত হচ্ছে।
উপজেলার চান্দাইকোলা ইউনিয়নের মৃত কায়ছার আলী সরকারের ছেলে আনোয়ারুল ইসলাম সরকার ও আব্দুর রউফসহ প্রভাবশালী ১৫ জন একত্রিত হয়ে অনুমতি ছাড়াই অটো রাইস মিল স্থাপন করছেন।
চান্দাইকোনা গ্রামের বাসিন্দা হাসান সরকার বলেন, মিলের কাছাকাছি ১০ মিনিট দাঁড়ানো যায় না। ছাই উড়তে থাকে পুরো এলাকায়। গাছপালার পাতা লাল হয়ে গেছে। গাছে ফল ধরে না। এলাকায় শিশু ও বৃদ্ধরা শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে ভুগছেন। এমনকি মিলের ছাই উড়ে এসে আমাদের খাবারে পড়ে। একই এলাকায় আরেকটি বড় অটো রাইস মিল হচ্ছে। এ মিলটি চালু হলে এলাকায় বসবাস করা কঠিন হবে।
কই গ্রামের মৃত কামাল সেখের ছেলে রাজ্জাক শেখ বলেন, রিয়া রাইস মিলের কারণে বর্তমানে বাড়িতে বসবাস করা খুব কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিলের উড়ন্ত ছাই, তুষ ও কুড়া ঘরের হাঁড়ি-পাতিলে গিয়ে পড়ে। বাড়ি ঘর, গাছপালা ও ফসলি জমি ছাইয়ের আবরণে কালো হয়ে গেছে। মিলের কারণে এ এলাকার অধিকাংশ মানুষ চোখের সমস্যাসহ শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা ও চর্ম রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
মিলের পাশের মুদি দোকানদার বলেন, মিলের উড়ন্ত ছাই, তুষ ও কুড়া পথচারী ও গাড়িলকদের চোখে পড়ায় অনেক সময় দুর্ঘটনাও ঘটছে।
তবে, রিয়া অটো রাইস মিলের মালিক আব্দুর রউফ বলেন, নিয়ম মেনেই মিল চালু করা হচ্ছে। সবকিছুর অনুমোদন আছে আমাদের। তবে, মিলে কিছু সমস্যা আছে। সেগুলো দ্রুত নিরসন করা হবে।
অটো রাইস মিলের আরেক অংশীদার বাবু সরকার বলেন, আমাদের কোনো কাগজপত্র নেই। নির্মাণকাজ শেষ হলে কাগজপত্র তৈরী করে সকল দপ্তরে আবেদন জমা দেওয়া হবে। সেই মোতাবেক কাজ চলছে।
চান্দাইকোনা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক কামরুজ্জামান সরকার বলেন, কালো ধোঁয়ায় স্কুলের আশপাশ অন্ধকার হয়ে আসে। চরম দুর্গন্ধ হয়। এতে আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে। স্কুলের আশপাশে কয়েকটি চাল কল আছে। সেসব চালকলের কালো ধোঁয়া, ছাই ও দূষিত পানির কারণে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি। সেখানে যদি আবার অটো রাইস মিল তৈরি হয়, তাহলে শিক্ষার্থীদের পাঠদান ব্যাহত হবে।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ভুঁইয়াগাঁতী জোনাল অফিসের (ডিজিএম) ছোলাইমান হোসেন বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া ওই মিলে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া যাবে না। এক মিলের লাইন কৌশলে মালিকপক্ষ যদি অন্য মিলে নিতে চায়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রায়গঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তৃপ্তি কণা মণ্ডল জানান, ওই রাইস মিলের ব্যাপারে স্থানীয়রা লিখিত অভিযোগ দিয়েছিল। অভিযোগের আলোকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিটি সঠিক তদন্ত না করায় আবার তদন্ত কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া অটো রাইস মিল চালু করা যাবে না। যদি কেউ অটো রাইস মিল চালুর চেষ্টা করেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ডিডি) বাবলু কুমার সূত্রধর বলেন, অটো রাইস মিল ও ইটভাটার ধোঁয়া ও ছাই পরিবেশ ও ফসলের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পরিবেশ ও খাদ্য অধিদপ্তরকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সিরাজগঞ্জ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আব্দুল গফুর বলেন, অটো রাইস মিলের কাজ বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তারা নির্দেশ না মানায় আমরা ঢাকায় মহাপরিচালক বরাবর অভিযোগ দিয়েছি। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সিরাজগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর জেনারেল ম্যানেজার আবু আশরাফ মো. ছালেহ্ বলেন, এক প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ সংযোগ অন্য প্রতিষ্ঠানের নেওয়া সম্পূর্ণ বেআইনি। যদি রিয়া ও বিসমিল্লাহ অটো রাইস মিলের মালিকরা এ ধরনের কাজ করে থাকেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ কাজের সাথে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কোনো লোক জড়িত থাকলে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা রিয়াজুর রহমান রাজু বলেন, আমি নতুন এসেছি। এ অভিযোগের বিষয়ে আমার জানা নেই। অটো রাইস মিলে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন না থাকলে তাদের লাইসেন্স দেওয়া হবে না।
তিনি আরও বলেন, ফসলি জমিতে কেউ অটো রাইস মিল স্থাপন করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।