করোনা ভাইরাসের প্রকোপে বিপর্যস্ত অর্থনীতির গতি ফেরাতে ব্যাংকগুলোকে ঋণসহায়তা প্রদানের নির্দেশনা দিলেও উদ্যোক্তাদের বেশির ভাগই সুবিধা পাননি। সরকারঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করতে ব্যাংকগুলোকে বেশ কিছু সুবিধাও দেওয়া হয়। সেই সুবিধা নিয়ে নিজেদের আর্থিক অবস্থান সুসংহত করেছে ব্যাংকগুলো।
নগদ মুনাফা তুলতে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। ঋণ ফেরত না পাওয়ার আশঙ্কার কথা বলে উদ্যোক্তাদের বঞ্চিত করেছে। যে কারণে করোনায় সরকারঘোষিত ঋণসহায়তার প্যাকেজ ফলপ্রসূ হয়নি বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, বাড়তি তারল্যের জোগান নিশ্চিত হওয়ায় পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে মুনাফা তুলছে ব্যাংকগুলো। এই সুবাদে এমনকি বন্ধ হওয়ার উপক্রম ছিল এমন ব্যাংকগুলোও এখন ভালো অবস্থায় পৌঁছেছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণসহায়তা না দিয়ে ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়ার সমালোচনাও করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, এ খাতের ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলোর টালবাহানা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা যথাসময়ে ও পরিমাণমতো ঋণ না পাওয়ায় প্রণোদনার প্রত্যাশিত সুফল মেলেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, গত বছরের শুরু থেকে করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ায় ব্যাংকগুলোও প্রণোদনাকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। মূলত প্রণোদনার ঋণ বিতরণই ব্যাংকগুলোর মূল কাজ হয়ে গিয়েছিল। অথচ এ কাজটি তারা ঠিকমতো করেনি। এখানে ন্যায্যতা রাখা হয়নি। হাতেগোনা বড় বড় প্রতিষ্ঠানকে মুখ দেখে ঋণ দেওয়া হয়েছে। মাঝারি ও ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ ঋণ সহায়তা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, অর্থনীতিকে আবারও আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে হলে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্প-উদ্যোক্তাদের সক্রিয় করা দরকার। সেই লক্ষ্য নিয়েই বিভিন্ন স্তরে ঋণসহায়তার প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণের বদলে প্রাপ্ত সুবিধা নিয়ে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করেছে। বড়দের ঋণসুবিধা দিলেও ছোট ও মাঝারিদের ঋণ বিতরণের চিত্র ছিল হতাশাজনক। কোনো কোনো প্যাকেজের এক থেকে দেড়শ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ হয়েছে মাত্র। অথচ ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলোকে আগ্রহী করতে খেলাপি করার সময় বাড়ানো, প্রভিশন কমানোসহ নানা ছাড় দেওয়া হয়েছে। এসবের পাশাপাশি ২ হাজার কোটি টাকার ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমও করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন ও এর সুফল দেওয়ার জন্য ব্যাংকগুলোর যেভাবে দায়িত্ব পালন করার দরকার ছিল তা তারা পারেনি। যাদেরকে ঋণ দেওয়া দরকার তারা ঋণ পায়নি। এখন জোর যার মুল্লুক তার অবস্থা’ হয়ে গেছে। ছোট ও দুর্বলরা ঋণ পাচ্ছে না। সরকার ও বিভিন্ন মহলে যাদের যোগাযোগ আছে তারাই ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে।
ব্যাংকগুলো যেসব সুবিধা পেল: প্যাকেজ বাস্তবায়নের জন্য ব্যাংকগুলোকে বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া হয়েছে। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক নগদ জমার হার (সিআরআর) ১ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে। আবার ঋণ আমানত অনুপাত সীমা (এডিআর) ২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। নীতি সুদহার বা রেপো দশমিক ৫০ শতাংশ কমানো হয়েছে। ১৯টি প্যাকেজের মধ্যে প্রায় সবগুলোতেই পুনঃঅর্থায়ন তহবিল থেকে টাকা দেবে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রণোদনা প্যাকেজের প্রায় অর্ধেকই আসবে পুনঃঅর্থায়ন তহবিল থেকে।
করোনার অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় সরকার ঘোষিত ১ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বড় শিল্প ও সেবা খাতের জন্য চলতি মূলধন বাবদ ৩০ ?হাজার কোটি টাকা ও এসএমই খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণের সুদের অর্ধেক পরিশোধ করবে সরকার, বাকি অর্ধেক গ্রাহক। ব্যাংকগুলোতে যাতে তারল্যসংকট না হয়, সে জন্য বড় অঙ্কের পুনঃঅর্থায়ন তহবিলও গঠন করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। করোনাকালীন সময়ে ব্যাংকগুলোর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সীমাও শিথিল করা হয়েছে।
এর আগে ৯ শতাংশ বা সিঙ্গেল ডিজিট সুদহার বাস্তবায়নের সময় ব্যাংকগুলো সরকারের কাছ থেকে নানা সুবিধা আদায় করে। তখন সরকারি আমানতের অর্ধেক বেসরকারি ব্যাংকে রাখতে সরকারকে বাধ্য করেন ব্যাংকের মালিকরা। এছাড়া এডিআর বাড়ানোসহ বেসরকারি ব্যাংকের সুবিধা হয় এমন অনেকগুলো বিধান করতে বাধ্য হয়। যদিও যে সময়ে ব্যাংক ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ করার কথা ছিল সে সময়ে করেনি ব্যাংকগুলো। এমনকি এখনো পর্যন্ত ডজনখানেক ব্যাংকের সুদহার ৯ শতাংশের বেশি।
ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবির চাহিদা অনুযায়ী যেসব সুবিধা দেওয়া হয়েছিল সেগুলো হলো—সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা, সিআরআর ১ শতাংশ কমানো, ঋণ আমানতের হার (এডিআর) সমন্বয়সীমার সময় বাড়ানো এবং রেপো রেট ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। তখনো ব্যাংকগুলো সুবিধা নিয়েও যথাসময়ে সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনেনি।
উদ্যোক্তাকে আটকিয়ে কার লাভ: করোনার অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের ঋণসহায়তা দিয়ে টিকিয়ে রাখলেই বরং দেশের অর্থনীতির জন্য লাভ। যে ব্যাংক অর্থায়ন করেছে তার লাভ। এই সময়ে চলতি মূলধন ঋণসুবিধা দিয়ে ব্যবসায়-উদ্যোগ চালু রাখলে ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে পারবেন উদ্যোক্তা। কর্মীদেরও সুরক্ষা হবে। নইলে খেলাপি ঋণের পরিমাণই কেবল বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণে বলেন, ধারণা ছিল বেসরকারি ব্যাংকের বিস্তৃতি ঘটলে ব্যাংকিং খাতের সুশাসন নিশ্চিত হবে। দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। কার্যত এখন দেখা গেছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো সিন্ডিকেটের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। এসব ব্যাংকেরও স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ।