বর্তমান বাজারের গতি প্রকৃতি দেখে আমরা বলতে পারি পুঁজিবাজারের উপর বিনিয়োগকারীর আস্থা ফিরে এসেছে। যাদের হাতে টাকা আছে তারা সকলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ শুরু করেছে। তারই প্রতিফলন আমরা এক্সচেঞ্জের টার্নওভারে দেখতে পাচ্ছি। আমরা সকলে আগামী তিন বছরের মধ্যে দৈনিক টার্নওভার ৫ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি, ইনশাআল্লাহ।
পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থা ধরে রাখতে এবং বাজারকে স্ট্যাবল এবং ভাইব্র্যান্ট রাখতে হলে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ফিরিয়ে আনা জরুরি। আমরা দেশব্যাপী সকলে একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিতামূলক ও গতিশীল পুঁজিবাজার দেখতে চাই। যে পুঁজিবাজারের মাধ্যমে ভালো শিল্প উদ্যোক্তারা বাজার থেকে টাকা তুলবে এবং তা শিল্প প্রতিষ্ঠান সম্প্রসারণ, আবাসন, নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজে ব্যবহার করবে এবং দেশের শিল্প উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানে অবদান রাখবে। ব্যাংক ব্যবস্থাপনার উপর বাড়তি কোন চাপ থাকবে না দীর্ঘমেয়াদী শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের জন্য।
বাজারে বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। প্রতিদিন নতুন নতুন বিনিয়োগকারী বাজারে আসছে। কোন অবস্থাতে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। বিএসইসি কমিশনকে কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে। বিএসইসি যত কঠোর অবস্থানে থাকবে ততবেশী বাজার ভালো থাকবে। বিএসইসি কোন অবস্থাতে বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করবে না, ইনডেক্সকে নিয়ন্ত্রণ করবে না। শেয়ারের দাম উঠানামা করলে ইনডেক্স বাড়ে এবং কমে। সেটাই স্বাভাবিক। বাজারে ফ্রি ফ্লট শেয়ার বেশি থাকলে বাজার স্বাভাবিক থাকে। ফ্রি ফ্লট শেয়ার যে কোম্পানির বেশি থাকে সে কোম্পানির শেয়ার ম্যানিপুলেট করে বাড়ানোর কোন সুযোগ নেই। কারণ যেসব কোম্পানির মৌল ভিত্তি ভাল এবং ফ্রি ফ্লট শেয়ার বেশী তারা নিজস্ব স্ট্রেংথ এ বাড়ে। এই সকল শেয়ারের ইপিএস, পি/ই রেশিও, রিজার্ভ, ব্যবসা সম্প্রসারণ, কোম্পানির মূলধন, দক্ষ পরিকল্পনা ও পরিচালনার কারণে অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারী বেশী বেশী বিনিয়োগ করতে আগ্রহী থাকে।
অপরদিকে ‘জেড’ গ্রুপের শেয়ার, স্মল পেইড-আপ ক্যাপিটাল শেয়ার, নন-পারফরম্যান্স শেয়ারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ম্যানিপুলেশন করে শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক ভাবে বাড়িয়ে ম্যানিপুলেট করে সহজে বাড়িয়ে নেওয়া যায়। এই সকল কোম্পানির লেনদেনের ক্ষেত্রে বিএসইসি এবং এক্সচেঞ্জকে কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে। বাজারকে এগিয়ে নিতে হলে লিস্টেড কোম্পানিগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা বিশেষ জরুরি। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন ২৪ শতাংশ হোল্ড করে এবং সবচেয়ে বড় বিষয় হলো এই সফল প্রতিষ্ঠানের ফ্রি ফ্লট শেয়ার অনেক বেশি।
বিনিয়োগকারীদের হাতে সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ার আছে। বাজারের গতিশীলতা ধরে রাখতে হলে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ব্যাংকে যারা স্পন্সর/ডিরেক্টর আছেন তাদের বুঝতে হবে। তারা ব্যাংকের মালিক নন তারা শেয়ারহোল্ডার। পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ থেকে এই সকল স্পন্সর/ডিরেক্টরদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। ব্যাংক ডিপোজিটরদের টাকায় চলে, সেসব পরিচালকের টাকায় চলে না। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, ব্যাংকের উদ্যোক্তা, পরিচালকেরা ২০০৯/২০১০ সালে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে, ১০ টাকার শেয়ার মার্কেটে ১৭০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন এবং হাজার হাজার বিনিয়োগকারীদের সাথে প্রতারণা করেছেন। আজ সেইসব শেয়ারের ফেসভ্যালু ১০ টাকার নীচে।
বর্তমান অর্থমন্ত্রী সংসদে বলেছিলেন, এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত ম্যানেজমেন্টের সাথে নামে/ বেনামে ভুল তথ্য দিয়ে বা ভুয়া জমি দেখিয়ে বা জাল দলিল পত্র দাখিল করে সরকারি খাস জমি বন্ধক রেখে ডোবা-খাল জলাশয় দেখিয়ে ১ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে। ব্যাসেল-৩ পরিপালন করার অযুহাতে বছরের পর বছর শুধুমাত্র বোনাস শেয়ার ইস্যু করে নিজেদের শেয়ার সংখ্যা বাড়িয়েছে অপর দিকে বেশি দামে শেয়ার কিনে বিনিয়োগকারী প্রচণ্ডভাবে লোকসানের কবলে পড়েছেন।
অপরদিকে ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া যে সকল কোম্পানির মৌলভিত্তি ভাল এবং ফ্রি ফ্লট শেয়ার বেশী, বাজারে তাদের শেয়ারের দামও বিগত বছরগুলোতে অনেক কমে গিয়েছিলো। কিন্তু ভালো ফান্ডামেন্টাল শেয়ার ধরে রাখতে পারলে কোন অবস্থাতেই বিনিয়োগকারীকে লাভ দিতে না পারলেও লোকসান গুনতে হয় না, ইতিহাসের দিকে তাকালে তা ষ্পষ্ট হয়। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে বিএসইসি-কে কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে। যে কোন অবস্থায় ব্যাংকগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দক্ষ ও সৎ ম্যানেজমেন্ট গড়ে তুলতে হবে এবং ব্যাংক পরিচালকদের বুঝাতে হবে এটা তার পারিবারিক প্রতিষ্ঠান না। ব্যাংক ডিপোজিটরদের ডিপোজিটের টাকায় চলে। এর মালিক সকল শেয়ারহোল্ডার। এখনো অনেক ব্যাংকের তথাকথিত স্পন্সর/ ডাইরেক্টররা বাংকগুলোকে তাদের পারিবারিক সম্পত্তি মনে করেন, তারা এটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না। অনেক সময় তারা নিয়ম-নীতিরও তোয়াক্কা করেন না। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্বতন্ত্র পরিচালকদের মতামতেরও তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। আমার জানামতে, অনেক ব্যাংক তাদের বোর্ড মিটিং/ কমিটি মিটিং এর প্রোসেডিং মিনিটস আকারে রাখেন না, রেকর্ড করে রাখেন। রেকর্ড যেকোনো সময় ধ্বংস করা সম্ভব।
বিএসইসি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক একসাথে কাজ করে বিনিয়োগকারীর স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। সৎ, পেশাদার ও নিবেদিত ক্ষুদ্র পরিচালক নিয়োগ দিতে হবে। যে সকল বিনিয়োগকারী এবং প্রতিষ্ঠানের ২ শতাংশ শেয়ার আছে তাদের পরিচালনা পর্ষদে সহজে সংযুক্ত করতে হবে। স্পন্সর, ডাইরেক্টরদের কোন কোন ওজর, আপত্তি চলবে না। কারণ আমরা বাস্তবে দেখি স্পন্সর ডাইরেক্টররা তাদের পছন্দমত পরিচালক নিয়োগ দিতে চান, এটা বন্ধ করতে হবে। যাদের ২ শতাংশ শেয়ার আছে তাদের অটোমেটিক্যালি বোর্ড এ ঢোকার পথ করে দিতে হবে। এতে যদি বোর্ডের আকার বাড়ে তাতে কোন অসুবিধার কারণ নেই। বরং এতে করে যারা বাজার থেকে শেয়ার কিনে পরিচালক হবেন তাদের দায়িত্ব, বিনিয়োগকারীদের প্রতি কমিটমেন্ট আরো বেশি থাকবে। এতে করে স্বতন্ত্র পরিচালক এবং শেয়ারহোল্ডার পরিচালকদের যৌথ পরিচালনায় ব্যাংকগুলো দুরবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। ব্যাংকের লুটপাট বন্ধ হবে। ব্যাংকের অব্যবস্থাপনা দূর হবে। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার প্রতি বিনিয়োগকারীর আস্থা বাড়বে। তাতে করে বাজার আরো ভাল ও বড় হবে। ব্যাংকের লেনদেন আরো বাড়বে।
ঋণ খেলাপিকে কঠোর আইনের আওতায় এনে টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। জনগণের টাকা লোন করে যাতে কেউ পার পেয়ে না যায় সেদিকে বিশেষ নজরদারি বাড়িয়ে অর্থমন্ত্রী বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসিকে কঠোর অবস্থানে থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। আমি আগে অনেকবার বলেছি এখনও বলছি, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের লাইফস্টাইল এ হাত দিতে হবে। দেউলিয়া আইনের সংশোধন করে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। কাউকে জেল দিয়ে কোন লাভ হবে না। লাইফস্টাইলে হাত দিলে দেখবেন অনেক টাকা পরিশোধ করে দিচ্ছে। কেউ আর নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করবে না। দেউলিয়া ঘোষণার কারণে তার বাড়ি গাড়ি কিছুই থাকেবে না, ছেলেমেয়েদের দামী স্কুলে পড়াতে পারবে না। প্লেনে চড়তে পারবে না। বিদেশে যেতে পারবে না। বড় বড় সরকারি-বেসরকারি পার্টিতে জয়েন করতে পারবে না। এই সকল ব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন দেশ চায়না, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, ভারত ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি থেকে ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত টাকা আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের সফল অর্থমন্ত্রীকে এই ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে বলব, আপনার সফলতা দিন দিন বাড়ছে, অনুরোধ করবো আপনি অর্থনীতির বিভিন্ন দিকগুলোর সাথে সামঞ্জস্য রেখে এই জায়গায় বাস্তবতায় আলোকে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য
বিনিয়োগকারী কোন সময়ে, কোন দামে শেয়ার কিনবে এটা তার একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। পৃথিবীর সবদেশে শেয়ারের দাম বাড়ে এবং কমে। ডিমান্ড/সাপ্লাই এর উপর শেয়ারের দাম নির্ভর করে, বিএসইসি কোন সময় কোন শেয়ারের দাম কত হবে তা নির্ধারণ করতে পারে না। এবং এটা বলতে পারে না যে কোন শেয়ারের দাম এত বৃদ্ধির ফলে পরবর্তী একমাস তার দর বৃদ্ধির তদারকি করতে। বিএসইসির কাজ এইটা না। বিএসইসির মূল কাজটা হলো বাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, আইন/ রুলস/ রেগুলেশনস এর কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা, ইনসাইডার ট্রেড/ মার্কেট ম্যানিপুলেশন বন্ধ করা।
বড় বড় বিনিয়োগকারীর সুবিধা হলো ভালো শেয়ার তারা যে দামে কিনুন না কেন শেয়ারের দাম যদি পড়েও যায় তারা চিন্তিত হন না কারন তারা শেয়ারটা ধরে রাখার ক্ষমতা রাখেন। পুঁজিবাজারের ইতিহাসে দেখা গেল একটি ভালো এবং ফান্ডামেন্টাল শেয়ারের দাম পড়ে গেলেও পরবর্তীতে তার দাম আবারো বাড়ে। অতএব, ভয় হলো শুধু ছোট ছোট বিনিয়োগকারীদের, যারা স্বল্প পুঁজি নিয়ে বাজারে আসেন, যারা বাজারে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ করতে চান না এবং অল্প সময়ে লাভ করতে চান। তাদের জন্য সবচেয়ে রিস্ক থেকে যায়। আমি বার বার বলছি যারা স্বল্প টাকা নিয়ে পুঁজিবাজারে আসবে তারা যেন সতর্কতার সাথে বিনিয়োগ করেন।
বিএসইসি কমিশন বাজারে স্বচ্ছতা/জবাবদিহিতা নিশ্চিত করেছেন। অতএব, আপনার দায়িত্ব আপনার কষ্টার্জিত সঞ্চয়ের একটি অংশ পুঁজিবাজারে দক্ষতার সাথে বিনিয়োগ করুন। আশা করি আপনি লাভবান হবেন ইনশআল্লাহ। শুধু বুঝবেন টাকাটা যেহেতু আপনার- দিনের শেষে লাভও আপনার, লোকসানও আপনার। এখানে কাউকে বিশেষ করে সরকারকে অথবা বিএসইসি কমিশনকে আপনার অভিযোগ করার কোন সুযোগ নেই।
পরিশেষে বলবো, বাজারের এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বিএসইসি সুশাসন অবশ্যই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শতভাগ সঠিক ডিসক্লোজারের ভিত্তিতে ভালো ভালো কোম্পানি আনতে হবে। বাজারে শেয়ার সরবরাহ বাড়াতে, সরকারি ভালো শেয়ার এনে বাজারকে আরোবেশী গতিশীল করতে হবে। পুঁজিবাজার হচ্ছে শিল্পায়নে এবং কর্মসংস্থানে টাকার মূল উৎস, ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয়।
লেখক: মো. রকিবুর রহমান
সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান পরিচালক
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) লিমিটেড।