শেয়ারবাজারে ২০২১ সালে তালিকাভুক্ত হয়েই ২০২০ সালের জন্য ১০ শতাংশ এবং ২০২১ সালের প্রথম প্রান্তিকের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন ২ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করে তাক লাগিয়ে দেন সোনালি লাইফের পরিচালনা পর্ষদ। তবে গত বছরের লভ্যাংশ যে শুধুমাত্র প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) পূর্ববর্তী শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ঘোষণা করা হয়েছিল, তা কারো জানা ছিল না। এক্ষেত্রে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে রেকর্ড ডেটকে পাশ কাটিয়ে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেয়ারধারনকারীদের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণা করে। যাতে করে রেকর্ড ডেটের দিন শেয়ারধারন করেও লভ্যাংশ বঞ্চিত হয় কোম্পানিটির সাধারন শেয়ারহোল্ডাররা। অবশেষে কোম্পানি কর্তৃপক্ষের এই প্রতারণা আটকে দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
সোনালি লাইফের পর্ষদের এমন কান্ডে রেকর্ড ডেটের দিন শেয়ারধারন করেও লভ্যাংশ না পাওয়ার মতো নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে সাধারন শেয়ারহোল্ডারদের সঙ্গে। যার সুযোগ শেয়ারবাজারে নেই। এ নিয়ে সর্বপ্রথম গত ২৬ সেপ্টেম্বর বিজনেস আওয়ারে ‘লভ্যাংশ নিয়ে সাধারন শেয়ারহোল্ডারদের সঙ্গে সোনালি লাইফের প্রতারণা’ শীর্ষক সংবাদ প্রকাশ করা হয়।
যার আলোকে গত ২৭ সেপ্টেম্বর বিএসইসি থেকে ব্যাখ্যা চেয়ে সোনালি লাইফ কর্তৃপক্ষকে চিঠি ইস্যু করা হয়। এরপরে গত বছরের নভেম্বরে আইপিও’র আগের শেয়ারধারীদের লভ্যাংশ প্রদানের বিষয়টি অগ্রহণযোগ্য বলে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সকে অবহিত করে ডিএসই।
সম্প্রতি বিএসইসি থেকে পাঠানো এ সংক্রান্ত একটি চিঠিতে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে আইপিও পরবর্তী লভ্যাংশ প্রদান সংক্রান্ত রেকর্ড ডেটের দিন শেয়ারধারী সকল বিনিয়োগকারীদের ১০ শতাংশ করে নগদ লভ্যাংশ প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে। বিষয়টি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই), চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) ও সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অবহিত করা হয়েছে।
বিএসইসির চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ২০২১ সালের ১০ জুলাই সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স ২০২০ সালে ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত হিসাব বছরের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে প্রাক-আইপিও শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। একইসঙ্গে ২০২১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময়ে (প্রথম প্রান্তিক) অন্তর্বর্তী ২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে কোম্পানিটি। আর ওই বছরের ২ সেপ্টেম্বর শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ বিতরণ করা হয়।
উল্লিখিত কার্যকলাপের মাধ্যমে, কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের লিস্টিং রেগুলেশন, ২০১৫ এবং প্রবিধান ২(১) ডিপোজিটরি (ব্যবহারিক) প্রবিধানমালা, ২০০৩ এর প্রবিধান ১৯(২) লঙ্ঘন করেছেন। এর ফলে কোম্পানিটিকে অলোচ্য রেকর্ড তারিখ অনুযায়ী শেয়ারধারীদের সমান পরিমাণ নগদ লভ্যাংশ (অর্থাৎ সব ধরনের শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ১০ শতাংশ) বিতরণ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো। আর এ চিঠি জারি করার ১৫ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিষয়টি কমিশনকে অবহিত করতে নির্দেশ দেওয়া হলো।
গত বছরের ৩০ জুন লেনদেন শুরু হওয়া সোনালি লাইফের পর্ষদ ১০ জুলাই ২০২০ সালের ব্যবসায় লভ্যাংশ সংক্রান্ত সভা করে। ওই সভায় কোম্পানিটির পর্ষদ ২০২০ সালের জন্য ১০ শতাংশ ও চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকের জন্য ২ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করে।
ওই লভ্যাংশের মধ্যে ১০ শতাংশ লভ্যাংশ গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর শেয়ার ধারনকারীরা অর্থাৎ আইপিও পূর্ববর্তী শেয়ারহোল্ডাররা পাবেন বলে মূল্য সংবেদনশীল তথ্যে প্রকাশ করে। বাকি ২ শতাংশ রেকর্ড ডেটের দিন (৪ আগস্ট) শেয়ার ধারনকারীরা সবাই পাবেন বলে জানায়। তবে এভাবে লভ্যাংশ ঘোষণার সুযোগ না থাকায়, ওইসময় সোনালি লাইফের প্রতারণার বিষয়টি কারো দৃষ্টিগোচর হয়নি।
কোম্পানি কর্তৃপক্ষের এমন ঘটনায় প্রকৃতপক্ষে ২০২০ সালের লভ্যাংশের জন্য ঘোষিত রেকর্ড ডেট এর কার্যকারিতা বলে কিছুই থাকে না। কারন রেকর্ড ডেট নির্ধারনই করা হয় পর্ষদের ঘোষিত লভ্যাংশ ওইদিন শেয়ারধারীরা পাবে এবং এজিএমে অংশগ্রহনের সুযোগের জন্য।
এদিকে স্বাভাবিকভাবেই অন্যসব কোম্পানির ন্যায় সোনালি লাইফের লভ্যাংশের ক্ষেত্রেও একইভাবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইটে লভ্যাংশের তথ্য প্রকাশ করা হয়। যে তথ্যে রেকর্ড ডেটের দিন শেয়ারধারনকারীরা সবাই লভ্যাংশ পাবেন বলে জানানো হয়। কিন্তু সোনালি লাইফ কর্তৃপক্ষ যে ২০২০ সালের লভ্যাংশ শুধুমাত্র উদ্যোক্তা/পরিচালকদের জন্য ঘোষণা করেছেন, তা ডিএসইরও দৃষ্টিগোচর হয়নি। কারন শেয়ারবাজারের ইতিহাসে এমন লভ্যাংশ ঘোষণার ইতিহাস নেই।
সোনালি লাইফ ইন্স্যুরেন্স কর্তৃপক্ষের এ ঘটনা শেয়ারবাজারের ইতিহাসে এক বিরল ও নেক্কারজনক। যেখানে উদ্যোক্তা/পরিচালকদেরকে লভ্যাংশ না নিয়ে সাধারন শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বিতরন করতে দেখা যায়, সেখানে সোনালি লাইফের পর্ষদ সাধারনদের বাদ দিয়ে নিজেরা নেবে।
এই প্রতারণার মধ্য দিয়ে এরইমধ্যে উদ্যোক্তা/পরিচালকেরা গত বছরের ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ নিয়ে চলেও গেছে। যা বিতরন করা হয়েছে বলে গত ১৬ সেপ্টেম্বর ডিএসইর ওয়েবসাইটে জানানো হয়েছে।