প্রস্টেট, স্তন, ফুসফুস, রক্ত, ত্বক, অন্ত্র-সহ প্রায় সব ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত কোষকেই মেরে ফেলার একটি অভিনব উপায়ের হদিশ মিলল। এই প্রথম।
কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা অবশ্য সফল হয়েছেন গবেষণাগারে ইঁদুর ও কোষের উপর চালানো পরীক্ষানিরীক্ষায়। মানুষের উপর এখনও সেই পদ্ধতির প্রয়োগ হয়নি। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার-ইমিউনোলজি’-র সাম্প্রতিক সংখ্যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী দিনে মানুষের উপর পরীক্ষাতেও সাফল্য এলে ক্যানসার চিকিৎসায় এই পদ্ধতিই সেরা বলে বিবেচিত হবে। গবেষকদের আশা, মানুষের ক্ষেত্রেও এই অভিনব পদ্ধতি প্রয়োগ করলে ক্যানসার চিকিৎসায় তা দিক-নির্দেশক হয়ে উঠবে।
নতুন পথের দিশা
গবেষকরা কাজ করেছেন আমাদের দেহের বিশেষ এক ধরনের প্রতিরোধী কোষ নিয়ে। দেহের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা (ইমিউন সিস্টেম) গড়ে ওঠে যে কোষগুলি দিয়ে। এই কোষগুলি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচার জন্য দেহের নিজস্ব প্রতিরোধী ব্যবস্থাকে গড়ে তোলে। আবার, সেগুলি ক্যানসারে আক্রান্ত কোষগুলিকেও (টিউমার) আক্রমণ করে। মেরে ফেলতে পারে।
কলকাতার ক্যানসার গবেষক সুশান্ত রায়চৌধুরীর কথায়, ‘‘এই পদ্ধতিতে মানুষের উপর পরীক্ষায় সাফল্য এলে ক্যানসার চিকিৎসার ক্ষেত্রে তা একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার হবে।’’
একই কথা বলছেন কলকাতার দুই বিশিষ্ট ক্যানসার চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় ও সোমনাথ সরকার। গৌতম ও সোমনাথের বক্তব্য, “এই ভাবে ক্যানসারে আক্রান্ত কোষগুলিকে চিহ্নিত করা আর সুস্থ কোষগুলিকে অক্ষত রেখে শুধুই ক্যানসার কোষগুলিকে আক্রমণ করে মেরে ফেলা সম্ভব হলে তা ক্যানসার চিকিৎসায় দিকনির্দেশক হয়ে উঠবে। ‘‘এর চেয়ে যুগান্তকারী আবিষ্কার আর কী হতে পারে ক্যানসার চিকিৎসায়? এর ফলে, অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ যেমন অনেক রকমের সংক্রমণ রুখতে ও সারাতে পারে, তেমনই একটি বা একই গ্রুপের ওষুধে প্রায় সব রকমের ক্যানসারই সারান যাবে’’, বলছেন সোমনাথ।
প্রতিরোধী কোষগুলি যে যে ভাবে ক্যানসার বা নানা ধরনের সংক্রমণে আক্রান্ত কোষগুলিকে আক্রমণ করে বলে এখনও পর্যন্ত আমাদের জানা আছে, কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দেখতে চেয়েছিলেন, সেই সব ছাড়াও অন্য কোনও উপায় রয়েছে কি না ক্যানসার কোষগুলিকে আক্রমণের ক্ষেত্রে। প্রতিরোধী কোষের আক্রমণের যে কলাকৌশলগুলি এখনও আমরা জানতে পারিনি।
খুঁজতে গিয়ে আমাদের রক্তে থাকা এক ধরনের প্রতিরোধী কোষের উপর নজর পড়ল গবেষকদের। যার নাম- ‘টি সেল’। এদের কাজ আমাদের শরীরটার ‘স্ক্যান’ করা।
‘স্ক্যানিং’-এর প্রয়োজন হয় কেন?
কোনও সংক্রমণের ঝড়ঝাপ্টার মুখে পড়তে চলেছে কি না আমাদের শরীর, স্ক্যানিং-এর মাধ্যমে আগেভাগে সেটা আঁচ করা। তার পর সেই সংক্রমণকে কী ভাবে রোখা যায়, তার ব্যবস্থা নেওয়া। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
কী ভাবে সেই ব্যবস্থা নেয় টি-সেল?
আমাদের দেহে দু’ধরনের প্রতিরোধী কোষ রয়েছে। একটি- ‘বি-সেল’। অন্যটি, টি-সেল।
বি-সেল কোনও সংক্রমণ হলেই রক্তে ছুঁড়ে দেয় ‘ক্ষেপণাস্ত্র’। বিশেষ বিশেষ সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য বিশেষ বিশেষ প্রোটিন।
টি-সেল ক্ষেপণাস্ত্র না ছুঁড়ে নিজেই পদাতিক বাহিনীর মতো এগিয়ে যায় শত্রুনিধনের জন্য। এক এক ধরনের টি-সেলের গায়ে লাগানো থাকে এক এক ধরনের ‘চাবি’। যার ‘তালা’টা থাকে ভাইরাস বা কোনও সংক্রমণে আক্রান্ত কোষগুলির গায়ে। টি-সেলগুলি তার চাবি নিয়ে চলে যায় সংক্রমণে আক্রান্ত কোষগুলির কাছে। তার গায়ে সেঁটে গিয়ে আক্রান্ত কোষের তালাটা বন্ধ করে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে সেই আক্রান্ত কোষে একটি রাসায়নিক বিক্রিয়া হয়। তার পর আক্রান্ত কোষটি মরে যায়। একই সঙ্গে বিক্রিয়া হয় তার গায়ে সেঁটে থাকা টি-সেলটির মধ্যেও। তাতে টি-সেলের সংখ্যা বেড়ে যায়। যাতে পরে ওই ধরনের সংক্রমণের হামলার মোকাবিলা আরও জোরালো ভাবে করা যায়।
তবে সব চাবি দিয়ে সব তালা বন্ধ করা যায় না। তাই কোনও এক ধরনের সংক্রমণে বা বিশেষ এক ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত কোষের তালা বন্ধ করতে টি-সেলেরও বিশেষ এক ধরনের চাবি লাগে। তাই যে টি-সেল নিউমোনিয়া রোখে, সেই টি-সেল ক্যানসার রুখতে পারে না। উল্টোটাও সত্যি। তাই দেহে নানা ধরনের টি-সেল থাকে। তাদের গায়ে থাকে নানা রকমের চাবি। এই চাবিই টি-সেলের ‘রিসেপ্টর’।
সুশান্তের কথায়, ‘‘গবেষণার অভিনবত্ব, এ বার একটি ইউনিভার্সাল তালার হদিশ মিলল। সব ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত কোষেই যে তালাটা থাকে। আর সেই তালাটা একটি বিশেষ ধরনের টি-সেলের চাবি (রিসেপ্টর) দিয়েই বন্ধ করে দেওয়া যায়।’’
গবেষণায় কী দেখা দিয়েছে?
এক ধরনের টি-সেল বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত কোষগুলিকে আক্রমণ করে তাদের মেরে ফেলতে পারে। প্রস্টেট ক্যানসারের কোষ মারতে পারে, মারতে পারে স্তন, ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত কোষগুলিকেও। আরও নানা ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত কোষকেও আক্রমণ করে মেরে ফেলতে পারে সেই বিশেষ ধরনের টি-সেল।
গবেষকদের অন্যতম কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যান্ড্রু সিওয়েল ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’-এর পাঠানো প্রশ্নের ই-মেল জবাবে লিখেছেন, ‘‘আগে এটা আমরা কেউই বিশ্বাস করতাম না। এটা সম্ভব বলে মনেও হয়নি কোনও দিন ক্যানসার বিজ্ঞানীদের। এখনকার চিকিৎসায় কোনও একটি ক্যানসারের ওষুধ বা চিকিৎসা পদ্ধতি অন্য ধরনের ক্যানসার সারাতে বা কমাতে কাজে লাগে না। কিন্তু এই পদ্ধতির মাধ্যমে অনেক ধরনের ক্যানসার সারানো সম্ভব হতে পারে। তাই আমাদের বিশ্বাস, মানুষের উপর পরীক্ষায় সাফল্য এলে এই পদ্ধতিকে ব্যবহার করে ক্যানসার চিকিৎসার নতুন নতুন ওষুধ বাজারে আসতে দেরি হবে না।’’
সিওয়েল এও জানিয়েছেন, এই বিশেষ ধরনের টি-সেল আর তার রিসেপ্টর ফুসফুস, ত্বক, স্তন, রক্ত, অন্ত্র, হাড়, প্রস্টেট, ওভারি (ডিম্বাশয়), কিডনি ও সার্ভাইক্যাল ক্যানসারে আক্রান্ত কোষগুলিকে সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছে আক্রমণ করতে পারছে। তাদের মেরেও ফেলতে পারছে। আর সেটা করতে গিয়ে ক্যানসার কোষের আশপাশে থাকা সুস্থ, স্বাভাবিক কোষগুলিকে তারা মেরে ফেলছে না। ক্যানসারের চালু চিকিৎসা পদ্ধতির বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হিতে বিপরীত হয়। ক্যানসার কোষগুলিকে মারতে গিয়ে সুস্থ কোষগুলিকেও মেরে ফেলা হয়। এই পদ্ধতিতে সেটা হচ্ছে না।
অভিনবত্ব কোথায়?
সুশান্ত জানাচ্ছেন, এত দিন দেখা গিয়েছে ক্যানসারে আক্রান্ত কোনও রোগীর রক্ত নিয়ে সেখান থেকে টি-সেল বের করে এনে তাকে ভাল ভাইরাস দিয়ে শক্তিশালী করে তুলে, সংখ্যায় বাড়িয়ে যদি সেই রোগীর শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, তা হলে সেই ক্যানসার রোগী সেরে ওঠেন। এই পদ্ধতির নাম- ‘সিএআর-টি থেরাপি’। কিন্তু কোনও এক জনের ‘এ’ গ্রুপের রক্ত যেমন ‘বি’ ব্লাড গ্রুপের অন্য জনকে দিয়ে বাঁচানো যায় না, তেমনই সিএআর-টি পদ্ধতিতেও শক্তিশালী করে তোলা টি-সেলটিকে সেই রোগীর শরীরে ঢোকালেই কাজ হবে, যাঁর রক্ত থেকে টি-সেল বের করা হয়েছিল। তা অন্য ক্যানসার রোগীদের কাজে লাগবে না। এমনকী, তা একই রোগীর বিভিন্ন পর্যায়েও কাজে না লাগতে পারে। কিন্তু নতুন পদ্ধতিতে এই থেরাপি যে কোনও রোগীর ক্ষেত্রেই করা যাবে। এমনকী, সুস্থ মানুষের রক্ত থেকে নেওয়া টি-সেলকে বাইরে এনে শক্তিশালী করে তুলে, সংখ্যায় বাড়িয়ে তাদের ক্যানসার রোগীর শরীরে ঢুকিয়ে দিয়ে।
‘হানাদারি’ কী ভাবে চালায় টি-সেল?
গবেষকরা বলছেন, ‘‘তার সবটা এখনও জানা সম্ভব হয়নি। যেটুকু জানা গিয়েছে, তা হল- টি-সেলের রিসেপ্টর আমাদের শরীরে থাকা একটি বিশেষ ধরনের অণুর সঙ্গে বার্তা বিনিময় করে। তার নাম- ‘এমআর-ওয়ান’। আমাদের দেহের সব ধরনের কোষেই থাকে এই এমআর-ওয়ান অণু। ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পর কোনও কোষে বিপাক প্রক্রিয়ায় যে ব্যাঘাত ঘটতে শুরু করেছে, সেই খবরটা ওই এমআর-ওয়ান অণুই দেয় টি-সেলের রিসেপ্টরকে।’’
ক্যানসারে আক্রান্ত স্তন
টি-সেলকে ব্যবহার করে ক্যানসার নিরাময়ে ওষুধ আবিষ্কার হয়েছে আগেও। যেমন, ‘সিএআর-টি’। সেই ওষুধের সাফল্যও কম নয়। কিন্তু সেই ওষুধ কার্যকরী হয় হাতেগোনা কয়েক ধরনের ক্যানসার নিরাময়ের ক্ষেত্রে। এই ওষুধ তখনই বেশি কার্যকরী হয়, যখন শরীরের ঠিক কোথায় ক্যানসার বাসা বেঁধেছে, কোন কোন কোষগুলি আক্রান্ত হয়েছে ক্যানসারে, তা সঠিক ভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। ক্যানসার চিকিৎসার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যা সম্ভব হয় না। তা ছাড়াও কোনও ক্যানসার মধ্যবর্তী বা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলে এই ওষুধ আর তেমন কার্যকরী হয় না।
‘সিএআর-টি’ পদ্ধতিতে ক্যানসার চিকিৎসা হয় কী ভাবে?
প্রথমত, ক্যানসারে আক্রান্ত কোনও রোগীর রক্ত নেওয়া হবে।
দ্বিতীয়ত, সেই রক্ত থেকে প্রতিরোধী টি-সেলগুলিকে পরিশ্রুত করে বের করে নেওয়া হবে।
তৃতীয়ত, সেই টি-সেলগুলিকে দেওয়া হবে একটি বিশেষ ভাইরাস। যা আদৌ ক্ষতিকারক নয়। সেই ভাইরাসগুলি টি-সেলকে দেবে জিন। যাতে সেই জিন-এর শক্তিতে শক্তিশালী হয়ে উঠে টি-সেলগুলি ক্যানসারে আক্রান্ত কোষকে চেনা ও তাদের আক্রমণ করার ব্যাপারে আরও দক্ষ হয়ে ওঠে।
চতুর্থত, শক্তিশালী করে তোলা টি-সেলগুলিকে এ বার সংখ্যায় বাড়ানো হবে।
পঞ্চমত, সেই টি-সেলগুলিকে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে ক্যানসার রোগীর শরীরে।
এ বারও সেই ভাবেই হবে। কিন্তু টি-সেলকে বের করে এনে শক্তিশালী করে তুলতে সুস্থ মানুষের থেকেও রক্ত নেওয়া যাবে। আর সেই শক্তিশালী টি-সেল ঢুকিয়ে দিয়ে সারিয়ে তোলা যাবে বহু ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীকে।
রয়েছে ভিন্ন মতও…
কলকাতার আর এক ক্যানসার বিশেষজ্ঞ স্থবির দাশগুপ্ত অবশ্য এই আবিষ্কার নিয়ে উল্লসিত নন। তাঁর মতে, “ক্যানসার দেখলেই তাকে “মেরে ফেলা সম্ভব”, এই দাবিটা ক্যানসার বিজ্ঞান এবং ডাক্তারির দর্শন, দু’দিক থেকেই ভুল। কারণ, ক্যানসার কোনও একটি ব্যাধির নাম নয়। প্রতিটি ক্যানসার তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে অনুপম। গবেষকরা যে সাফল্যগুলো পান, সেগুলো গবেষণাগারেই সীমাবদ্ধ থাকে, কেননা গবেষণা হয় প্রতিস্থাপিত ক্যানসার নিয়ে। বাস্তবে সেগুলো খাটতে চায় না। এটা বায়োলজির সমস্যা।”
স্থবিরের বক্তব্য, ক্যানসার ইমিউনিটি নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা সংক্রমণের সঙ্গে ক্যানসারকে একই সারিতে বসিয়ে দেন। তাতে গবেষণার সুবিধা, কিন্তু ক্যানসার বিজ্ঞানের অসুবিধা। এখানেও একই কাজ করা হয়েছে।
তাঁর কথায়, ‘‘ওঁরা বলছেন, এই ধরনের চিকিতসায় (যদি আদৌ কখনও হয়) স্বাভাবিক কোষের ক্ষতি হবে না। এটা চূড়ান্ত মিথ্যা। কারণ, স্বাভাবিক কোষ বিপর্যস্ত হয়, এমনকী, রোগীর প্রাণসংশয়ও হয়। তার বৈজ্ঞানিক ব্যাকরণও আছে। মূল কথা এই যে, ক্যানসার কোষের সঙ্গে স্বাভাবিক কোষের তফাৎ শুধুই তার ব্যবহারে। তাই স্বাভাবিক কোষকে আড়ালে রাখা যায় না। সবচেয়ে মজার কথা, গবেষকরা জানাচ্ছেন, এই গবেষণায় নাকি প্রমাণ হল যে, একই মাপ সকলের জন্যই খাটে! আমার নিজের মনে হয়, এগুলো ভাবনার দেউলিয়াপনা ছাড়া অন্য কিছু নয়।’’
তবে এর আগে ক্যানসার গবেষণায় যে এমন দিশা মেলেনি, তা কিন্তু প্রায় সকলেই মেনে নিচ্ছেন।-আনন্দবাজার