নিজস্ব প্রতিবেদক : কার্বন নির্গমনের জন্য দায়ী জীবাশ্ম জ্বালানির একটি হচ্ছে তেল। আর তেলের অন্যতম বড় উৎপাদক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে এবার ‘কার্বন নির্গমন কমানো’ বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে শুরু হচ্ছে জাতিসংঘের জলবায়ু শীর্ষক সম্মেলন কপ-২৮। দেশটির দুবাইয়ের এক্সপো সিটিতে বৃহস্পতিবার (৩০ নভেম্বর) থেকে শুরু হওয়া আলোচিত এই সম্মেলন চলবে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। গত বছর মিশরের শারম আল-শেখে অনুষ্ঠিত হয় কপ’র ২৭তম সম্মেলন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যে লড়াই চলছে, তার পটভূমিতে দাঁড়িয়ে প্রতিবারের মতো এবারের সম্মেলনেও বেশ কিছু প্রত্যাশা থাকবে বিশ্ববাসীর। প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলায় বৈশ্বিক লড়াইয়ের প্রশ্নে কার্যকর ও জুতসই উদ্যোগের অবতারণা ঘটবে বলেও প্রত্যাশা থাকবে। জলবায়ু অর্থায়ন (ক্লাইমেট ফান্ডিং) বৃদ্ধির পাশাপাশি জ্বালানি স্থানান্তরের (জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বের হয়ে নবায়নযোগ্য উৎসের সন্ধান) বিষয়ও গুরুত্ব পাবে সম্মেলনে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের মতে, সম্মেলনে চারটি বিষয় বিশেষভাবে গুরুত্ব পেতে পারে। এক, জ্বালানি ব্যবহার স্থানান্তর। দুই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃত্বে ৬০টিরও বেশি দেশের সমন্বয়ে একটি জোট গঠন করে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত রুখতে কাজ করা। তিন, জলবায়ু অর্থায়ন (তহবিল) বাড়ানো। চার, জলবায়ু অভিযোজন ও স্থিতিস্থাপকতা এবং টেকসই উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য রক্ষার বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
এ ছাড়া বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আসন্ন কপ-২৮ সম্মেলনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কার্যকর কোনও চুক্তির নেতৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমে জীবাশ্ম জ্বালানি নির্গমনকে ‘শূন্যে’ নামিয়ে আনার প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিতে পারে।
ইউএন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ মিটিং, তথা এবারের জলবায়ু সম্মেলনের সভাপতি করা হয়েছে আরব আমিরাতের জাতীয় তেল কোম্পানি অ্যাডনকের প্রধান নির্বাহী সুলতান আল-জাবেরকে। এরই মধ্যে তিনি সম্মেলনের বিষয়ে মতামত প্রকাশ করেছেন। আল-জাবের বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে ধীরে ধীরে সরে আসার বিষয়টি ‘অবশ্যম্ভাবী’। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তেল শিল্পকেও জড়াতে হবে বলেও মনে করেন তিনি। তাই, তেল ও গ্যাস উত্তোলনের সময় কার্বন নির্গমন কমাতে কোম্পানিগুলোর সহায়তা চেয়েছেন আল-জাবের।
ধারণা করা হচ্ছে, এসব কারণে এবার আগের যে কোনো সম্মেলনের চেয়ে অনেক বেশি ব্যবসায়ী অংশ নিতে যাচ্ছেন। এতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ব্রিটেনের রাজা চার্লসসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ অংশে নেবেন বলে জানা গেছে। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন থাকবেন না। এ ছাড়া, পোপ ফ্রান্সিস শেষ সময়ে আরব আমিরাতের সফর বাতিল করেছেন। যে কারণে তার এই শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়া হচ্ছে না।
সম্মেলনে অংশ নেবেন সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়িক ও আর্থিক নেতা, তরুণ আইনজীবী, আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। বিভিন্ন লবিস্টের পাশাপাশি সম্মেলনে অংশ নেবেন জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানির প্রতিনিধিরাও।
বিশ্বের দুই বৃহত্তম গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনকারীর এবারের সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করতে যাচ্ছেন। মার্কিন জলবায়ু-দূত জন কেরির অংশগ্রহণের কথা রয়েছে। উপস্থিত থাকবেন চীনের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি জি জেনহুয়াও।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কয়লা, তেল ও গ্যাসের ব্যবহার বন্ধ করা উচিত, নাকি জলবায়ুর ওপর এসব শিল্পের প্রভাব কমাতে প্রযুক্তি উদ্ভাবনে গুরুত্ব দেওয়া উচিত- তা নিয়ে দেশগুলোর মধ্যে বিভাজন রয়েছে। সম্মেলনে সেই বিভাজন আরও স্পষ্ট হতে পারে। বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে বিভিন্ন দেশ যেসব অঙ্গীকার করেছে, তা বাস্তবায়ন কতদূর- তা নিয়ে সম্মেলনে আলোচনা হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব দেশে খরা, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে, তাদের সেই ক্ষতি পুষিয়ে দিতে একটি তহবিল গঠন চূড়ান্ত করার চেষ্টা করা হবে। ইতোমধ্যে এর খসড়া তৈরি হয়েছে। তবে সম্মেলনে সেটি অনুমোদন পেতে হবে।
এদিকে, দুবাই জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৮ এ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের জলবায়ু ন্যায্যতা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক ও ক্যাপস। একইসঙ্গে দেশের বরেন্দ্র অঞ্চল, উপকূল অঞ্চল, হাওর-জলাভূমি অঞ্চল, চরাঞ্চলের জন্য আলাদা জলবায়ু প্রস্তাব এবং জলবায়ু সংকটাপন্ন নগরের দরিদ্র মানুষদের দাবিও তুলে ধরা হয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে।
প্রসঙ্গত, বিশ্বের ধনী ও উন্নত দেশের প্রায় ১ শতাংশ মানুষ যে পরিমাণ কার্বন নির্গমন করে, সে পরিমাণ কার্বন নির্গমন করে বিশ্বের প্রায় ৬৬ শতাংশ মানুষ। বাংলাদেশ এই ৬৬ শতাংশ কার্বন নির্গমনকারী দেশের কাতারে আছে। বৈশ্বিক কার্বন নির্গমনের ভেতর বাংলাদেশের কার্বন নির্গমনের পরিমাণ মাত্র ০.০৪ শতাংশ।
বারসিকের পরিচালক পাভেল পার্থ বলেন, কম পরিমাণ কার্বন নির্গমন করেও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে বেশি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশকে প্রায় ত্রিশটি কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। এর ভেতর উপকূল, বরেন্দ্র, চর, পাহাড়, বনভূমি, গড়, হাওর-জলাভূমি এবং নদী সমতল অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন দুর্যোগ ও বিপদ একইভাবে প্রভাব ফেলে না। প্রতিটি অঞ্চলে এবং প্রতিটি অঞ্চলের নানা পেশাজীবী জনগোষ্ঠীর ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন রকমের প্রভাব রয়েছে। তাই অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন এলাকার মানুষের জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত সমস্যাগুলো আলাদাভাবে আলোচিত হতে হবে।