গাইবান্ধা প্রতিনিধি : সম্প্রতি নদীবেষ্টিত গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদের বিস্তীর্ণ বালুচরে ছয়টি মূল্যবান খনিজ পদার্থের সন্ধান পাওয়া গেছে।
জয়পুরহাটে অবস্থিত ইনস্টিটিউট অফ মাইনিং, মিনারেলজি অ্যান্ড মেটালার্জি নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এমন তথ্য জানিয়েছে। শুধু তাই নয়, গবেষণায় এসব মূল্যবান খনিজ সম্পদের বর্তমান বাজার মূল্য হাজার হাজার কোটি টাকা।
গণমাধ্যমকে দেওয়া প্রতিষ্ঠানটির তথ্য ও প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা গেছে, প্রতি এক বর্গকিলোমিটার এলাকায় প্রাপ্ত খনিজ সম্পদের টেকনো ইকোনমিক ইভাল্যুয়েশন ছাড়াই দাম অন্তত ৩ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা। কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার বিভিন্ন বালুচর থেকে ১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন বালু সংগ্রহ করা হয়েছিল।
খনিজ প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে বিভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রতি টন বালু থেকে ২ কেজি ইলমিনাইট, ২শ’ গ্রাম রুটাইল, ৪ শ’ গ্রাম জিরকন, ৩.৮ কেজি ম্যাগনেটাইট, ১২ কেজি গারনেট ও ৫০ কেজি কোয়ার্টজ মিনারেল পাওয়া গেছে। ১০ মিটার গভীরতায় প্রতি এক বর্গকিলোমিটার এলাকা থেকে উত্তোলনের পর নির্মাণকাজে ব্যবহৃত বালুর বাজারমূল্য ৮০ থেকে ১০০ কোটি টাকা। আর সমপরিমাণ এলাকা থেকে প্রাপ্ত খনিজের বাজার মূল্য তিন হাজার ৬৩০ কোটি টাকা। তবে কোন প্রক্রিয়ায়, কোন প্রতিষ্ঠান এসব খনিজ আহরণ করবে, সেটা নির্ধারণ করবে সরকারের জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ।
মূল্যবান খনিজ পদার্থগুলো হলো- ইলমেনাইট, রুটাইল, জিরকন, ম্যাগনেটাইট চুম্বক ও ইস্পাত, গারনেট ও কোয়ার্টজ। এছাড়া বালুতে আরও অন্য কোনো খনিজ পদার্থ আছে কিনা, সেটা নিয়েও গবেষণা করছে প্রতিষ্ঠানটি।
যেসব কাজে ব্যবহৃত হয় মূল্যবান ছয় খনিজ:
ইলমেনাইট : ১৭৯১ সালে পাহাড়ি উপত্যকার স্রোত থেকে উইলিয়াম গ্রেগর এটি আবিষ্কার করেন। এই এলাকাটি মানাকানের একটি গ্রামে অবস্থিত। সর্বপ্রথম রাশিয়ার ইলমেনেস্কি পর্বতশ্রেণীতে ইলমেনাইট আবিষ্কৃত হয়। জায়গাটির নামানুসারে এর নাম হয় ইলমেনাইট। ইলমেনাইট হল টাইটানিয়াম ডাই অক্সাইডের প্রধান উৎস; যা রং, কাপড়, প্লাস্টিক, কাগজ, সানস্ক্রিন, খাদ্য এবং প্রসাধনীতে ব্যবহৃত হয়।
রিটাইল : ওয়েলডিং রড, কালি, খাবার, কসমেটিকস ও ওষুধ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় রুটাইল। অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ইতালি, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, সিয়েরা লিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র মূল্যবান এই খনিজটি সারা বিশ্বে রপ্তানি করে।
জিরকন : জিরকন ব্যবহৃত হয় সিরামিক, টাইলস, রিফ্যাক্টরিজ ও মোল্ডিং স্যান্ডসে (ছাঁচ নির্মাণে ব্যবহৃত বালু)। বর্তমানে সারা বিশ্বে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, চীন, ব্রাজিল, সিয়েরা লিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র এ খনিজ উপাদানটি রপ্তানি করে থাকে।
ম্যাগনেটাইট চুম্বক ও ইস্পাত : ম্যাগনেটাইট চুম্বক ও ইস্পাত উৎপাদন, খনি থেকে উত্তোলিত কয়লা পরিষ্কার করা এবং তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে গভীর কূপ খননে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বিশ্বের মাত্র দু’টি দেশ মূল্যবান এ খনিজটি সারা বিশ্বে রপ্তানি করে থাকে। দেশ দু’টি হলো দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া।
গারনেট : গারনেট হলো ভারি ও মূল্যবান খনিজ। এটি ব্যবহার করা হয় সিরিশ কাগজ উৎপাদন, লোহাজাতীয় পাইপ পরিষ্কার ও বালুতে বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া ও ভারত সারা বিশ্বে খনিজটি রপ্তানি করে থাকে।
কোয়ার্টজ : কোয়ার্টজ বা কোয়ার্টজাইট একটি আলংকারিক পাথর। এটি দেওয়ালে, ছাদের টালি হিসেবে, মেঝেতে কিংবা সিঁড়ির ধাপ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। রান্নাঘরের কাউন্টারটপ হিসেবে এর ব্যবহার দ্রুত বর্ধনশীল। এটি গ্রানাইটের তুলনায় অধিকতর দৃঢ় এবং দাগ প্রতিরোধী। বিচূর্ণ কোয়ার্টজাইট অনেক সময় সড়ক নির্মাণে ব্যবহৃত হয়।
খনিজ সম্পদ নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান জয়পুরহাটের ইনস্টিটিউট অব মাইনিং, মিনারেলজি অ্যান্ড মেটালার্জির পরিচালক ড. মোহাম্মদ নাজিম জামান মুঠোফোনে বলেন, ‘আমি আর বিবৃতি দেব না। তাছাড়া জয়পুরহাট থেকে আমাকে ঢাকায় বদলি করা হয়েছে। এ বিষয়ে এখন থেকে বাংলাদেশ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের আওতাধীন বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা বিবৃতি দিবেন।’
আপনার গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলে যেসব মূল্যবান খনিজ সম্পদ পাওয়ার কথা বলেছেন, সেগুলো উত্তোলনের জন্য অস্ট্রেলিয়ার একটি কোম্পানি চুক্তি করতে চাইছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখনো সেটা চূড়ান্ত হয়নি। তারা খনিজ সম্পদ আহরণের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছে বলে শুনেছি। এরপর সরকার সেটা যাচাই-বাছাই এবং দেশের স্বার্থ ভেবে সিদ্ধান্ত নেবে’।
কবে শুরু করেছিলেন এই কার্যক্রম? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গাইবান্ধার নদী অববাহিকায় যেসব চর আছে, সেসব চর নিয়ে প্রথমে আমরা জিওফিজিক্যাল সার্ভে করি। কোন জায়গায় কোন ধরনের মিনারেলস আছে, সেটার প্রাথমিক জরিপ শুরু হয় ২০১০ সালে। ২০১২ সালে জরিপের প্রাথমিক কাজ শেষ করা হয়। এই জরিপ কার্যকরী হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়ে একটি পাইলটিং প্রকল্পের নির্দেশনা দেন। এরপর ২০১৭ সালে একটি এটিপি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। সেই প্রকল্প অনুযায়ী, জয়পুরহাটে একটি খনিজ গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। গবেষণায় গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্র নদে মূল্যবান খনিজ সম্পদের সন্ধান পাওয়া যায়।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শুক্রবার (৮ মার্চ) দুপুরে বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আলী আকবর মুঠোফোনে বলেন, ‘আসলে গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্রের বালুকণাতে ১৫ থেকে ২০ ধরনের মিনারেল পাওয়া গেছে। কিন্তু যে প্রতিষ্ঠান এসব খনিজ সম্পদ উত্তোলন করতে চায়, তারা ৬টি মিনারেলকে গুরুত্ব দিতে চায়। এ কারণে ৬টি মিনারেলের কথা সবাই জানতে পেরেছে। বাকি মিনারেলগুলোও দেশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। সবকিছু বিবেচনা করে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।’