নিজস্ব প্রতিবেদক : পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাসনিয়া জাহান তনয়া (১২)। পেটে হঠাৎ প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে ছটফট করতে থাকে। নেওয়া হয় সোনারগাঁর সদর হাসপাতালে। ডাক্তার ওষুধ দেন। খেয়ে ভালোও হয়ে যান তাসনিয়া। তবে কিছু টেস্টও দেওয়া হয়।
চলতি মাসের ১৮ মার্চ বাবার সঙ্গে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে আদদ্বীন হাসপাতালে আসেন তাসনিয়া। টেস্টে ধরা পড়ে অ্যাপেন্ডিসাইটিস। চিকিৎসক দ্রুত অপারেশনের পরামর্শ দেন। চিকিৎসকের পরামর্শে পরদিনই আবার মায়ের সঙ্গে হাসপাতালে আসেন তাসনিয়া। একা একা হেঁটে ঢুকে অপারেশন থিয়েটারে। তবে, ফিরেছে লাশ হয়েছে।
গত ১৯ মার্চ দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বসুন্ধরা শাখার আদদ্বীন হাসপাতালে অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশন করাতে গিয়ে মারা যায় তাসনিয়া। পরিবারের অভিযোগ, চিকিৎসকদের অবহেলায় মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। এ অভিযোগে মামলাও করেন তাসনিয়ার বাবা বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন (সোনারগাঁও জাদুঘর)-এর গাইড লেকচারার মনিরুজ্জামান। মামলা দায়েরের পর হাসপাতালের ৪ চিকিৎসক ও ম্যানেজারসহ পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
গ্রেপ্তাররা হলেন- হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক চিকিৎসক ডা. শামসুদ্দিন আহাম্মদ, এনেসথেসিয়ার সহকারী অধ্যাপক ডা. তাসফিয়া মাহমুদ, এনেসথেসিয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপক ডা. আজমেরী আলীম, মেডিক্যাল অফিসার ও সার্জারি বিভাগের সহকারী রেজিস্টার ডা. নিহাল মোহাম্মদ ফাতিন ও হাসপাতালের ম্যানেজার আনোয়ারুল হোসাইন।
১৯ মার্চ পুলিশ তাদের আদালতে হাজির করে প্রত্যেকের তিন দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। আসামিদের পক্ষে তাদের আইনজীবীরা রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন। ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মাসফিকুল ইসলাম রিমান্ড আবেদন নাকচ করে আসামিদের জামিনের আদেশ দেন। আদেশে বিচারক বলেন, ‘আসামিদের বিরুদ্ধে জামিনযোগ্য ধারার অপরাধ। এ অবস্থায় আসামিদের রিমান্ডের আবশ্যকতা নেই। সার্বিক বিবেচনায় আসামিদের রিমান্ডের আবেদন নামঞ্জুর করা হলো। জামিন বিবেচনাযোগ্য। সার্বিক পর্যালোচনায় আসামিদের পাঁচ হাজার টাকা মুচলেকায় একজন আইনজীবী এবং একজন গণ্যমান্য ব্যক্তির জিম্মায় আগামী ধার্য তারিখ পর্যন্ত জামিন মঞ্জুর করা হলো। আগামী ৩০ এপ্রিল মামলাটির পরবর্তী তারিখ ধার্য রয়েছে।’
জানতে চাইলে তাসনিয়ার বাবা মনিরুজ্জামান বলেন, ‘গত ১৪ মার্চ তাসনিয়ার হালকা পেটে ব্যথা হয়। পরদিন সোনারগাঁও উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে যাই। তারা ওষুধ দেন। ওষুধ খেয়ে মেয়েটার ব্যথা কমে যায়। তবে তারা কিছু টেস্ট দিয়েছিল। ওই হাসপাতালের মশিউর রহমান নামে একজন পরিচিত ছিলেন। তার মাধ্যমে যাই। ১৬ মার্চ হাসপাতালে গিয়ে ইউরিন ও ব্লাড টেস্ট করাই। আল্ট্রাসনোগ্রামটা করা হয়নি। ইউরিন টেস্টে কোনও কিছু ধরা পড়েনি। তবে, ব্লাড টেস্টে অ্যাপেন্ডিস ধরা পড়ে।’
তিনি বলেন, ‘ডা. শামসুদ্দিন আহম্মেদ দ্রুত অপারেশন করতে বলেন। ১৯ মার্চ সকালে মেয়ে ওর মায়ের সঙ্গে হাসপাতালে যায়। অফিসের কিছু কাজ থাকায় আমার একটু লেট হয়। সাড়ে ১০টার দিকে আমিও যাই। আমি যাওয়ার আগেই আমার স্ত্রীর কাছ থেকে সম্মতি নিয়ে তাসনিয়াকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যায়। সাড়ে ১১টার দিকে আমার ভায়রা হাসপাতালে আসেন। আমি তাকে আনতে নিচে যাই। ১২টার দিকে দেখি ডাক্তারসহ অন্যান্যরা দৌড়াদৌড়ি করছে। জিজ্ঞাসা করলে কিছু বলে না। পরে দেখি ডা. শামসুদ্দিন আহম্মেদ অপারেশন থিয়েটারে ঢুকছেন। আমার মনে প্রশ্ন আসে, উনি (শামসুদ্দিন আহম্মেদ) যদি বাইরে থাকেন তাহলে আমার মেয়ের অপারেশন করলো কে? জোর করে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে যাই। দেখলাম অনেক ডাক্তার, নার্স সেখানে। আমি অপারেশন থিয়েটারের ঠিক গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করছি। ১০ মিনিট পর আমাকে ভেতরে নিয়ে যায়। বসার জন্য একটা চেয়ার দেয়। বুঝে যাই, কোনও দুর্ঘটনা ঘটেছে। দেখি মেয়েটার মুখ সাদা হয়ে গেছে। এরই মাঝে ওর মাও সেখানে চলে আসে।’
মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমার সহজ-সরল মেয়েটা নিজে হেঁটে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকলো। আর বের হলো লাশ হয়ে। মেয়েটা মেধাবী ছিল। সোনারগাঁও উদয়ন আদর্শ বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণিতে পড়তো। রোল ছিল ৮। খুব কমপিটিশন হত স্কুলে। ওর আশা ছিল, বড় হয়ে ডাক্তার হবে। সায়েম নামে ওর এক খালাতো ভাই ডাক্তার ছিল। ওকে দেখলে মাকে বলত, ‘‘মা সায়েম ভাই পুরুষ ডাক্তার আর আমি মহিলা ডাক্তার হব’’। ডাক্তারের অ্যাপ্রোন পরা কাউকে দেখলে তাকিয়ে থাকত।’
তিনি বলেন, ‘যাদের অবহেলার কারণে মেয়েটাকে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হলো তাদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা চাই। এজন্য মামলা করেছি। কিন্তু কী হলো? মামলা করলাম। পুলিশ আসামি গ্রেপ্তারও করলো। আমি যখন আমার মেয়ের দাফন-কাফন নিয়ে ব্যস্ত, তখন আসামিরা জামিন পেয়ে গেল।’
এদিকে, মেয়েকে হারিয়ে কাঁদছেন মা। মনিরুজ্জামান বলেন, ‘সন্তান হারানোর বেদনা আমরা বুঝতেছি। ওর মা সারাদিন কান্নাকাটি করে। মা-বাবা তো মা-বাবাই। সন্তান যেমনই হোক বাবা-মায়ের কাছে সে-ই শ্রেষ্ঠ। আবার সন্তানের কাছেও তার বাবা-মা সবচেয়ে ভালো বাবা-মা। আর যেন কোনও বাবা-মায়ের বুক খালি না হয়। অল্প বয়সে তাসনিয়ার মত কাউকে চলে যেতে না হয়।’
তাসনিয়ার মা রিক্তা পারভীন বলেন, ‘ওটা ডাক্তারখানা না, কসাইখানা। আমার মেয়ের মৃত্যুর পরে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে দেখি এখানে অপারেশনের কোনও পরিবেশই নেই। নোংরা, অক্সিজেনের কোনও ব্যবস্থা নেই। তারা আমার মেয়েটাকে মেরে ফেলল। আমি সরকারের কাছে মেয়ে হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই।’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার সাব-ইন্সপেক্টর নির্মল কুমার আগরওয়াল বলেন, ‘মামলা দায়েরের পর এজাহারভুক্ত পাঁচ আসামিকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ড আবেদন করে আদালতে পাঠাই। বিজ্ঞ আদালত তাদের জামিন দিয়েছেন। মামলার তদন্ত চলছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্টের অপেক্ষায় আছি। এটা একটা মেডিক্যাল টার্ম। বিশেষজ্ঞদের মতামত প্রয়োজন। রিপোর্ট পেলে জানা যাবে মৃত্যুর আসল রহস্য। তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করব।’
আসামিপক্ষের আইনজীবী আনিসুর রহমান বলেন, মেয়েটার অপারেশন করেছিল। পরে তার প্রেশার লো হয়ে যায়। হার্টবিট কমে মেয়েটা মারা গেছে। কোনও ডাক্তার রোগীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে চান না। আমি মনে করি, এখানকার ডাক্তারদেরও এমন কোনও মন-মানসিকতা ছিল না।
তিনি বলেন, মেয়েটা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে। এখানে কারও কোনও অবহেলা ছিল না। আমরা বিষয়টা আদালতকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। জামিনযোগ্য ধারা, এজন্য বিজ্ঞ আদালত তাদের জামিন দিয়েছেন। জামিন তো মামলার একটি পার্ট। মামলার তদন্ত হবে। চার্জশিট হবে। অভিযোগ গঠন হবে। সাক্ষ্যগ্রহণ হবে। এরপর মামলা একটা পর্যায়ে যাবে। আশা করছি, আসামিরা ন্যায়বিচার পাবেন।
মনিরুজ্জামান মামলায় অভিযোগে লেখেন, তাসনিয়ার পেটে ব্যথাজনিত সমস্যার কারণে গত ১৮ মার্চ দুপুর ২টা ১০ মিনিটের দিকে ঢাকা জেলার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানাধীন বসুন্ধরা আদদ্বীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করি। ডা. শামসুদ্দিন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান, তাসনিয়ার অ্যাপেন্ডিসজনিত পেট ব্যথা। জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শে মনিরুজ্জামান অপারেশন করতে রাজি হন। সে মোতাবেক ১৯ মার্চ সকাল ১০টা ২০ মিনিটের দিকে আসামিরা তাসনিয়াকে অপারেশন করেন। কিন্তু তাসনিয়ার জ্ঞান আর ফিরে আসে না। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক ১২টা ৩৩ মিনিটের দিকে তাসনিয়াকে মৃত ঘোষণা করেন। মনিরুজ্জামানের অভিযোগ, চিকিৎসকদের অবহেলায় তার মেয়ে তাসনিয়ার মৃত্যু হয়েছে।