রাঙামাটি প্রতিনিধি : দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ কাপ্তাই। ১৯৬০ সালে ৭২৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে গড়ে তোলা কাপ্তাই হ্রদের এখন বয়স প্রায় ৬৪ বছর। নাব্য সঙ্কটে পড়া কাপ্তাই হ্রদে ড্রেজিং নিয়ে শুধু কথা হয়, কাজ শুরু হয়নি আজ পর্যন্ত। এই ৬৪ বছরে বর্জ্য ও উজান থেকে নেমে আসা পলিতে কাপ্তাই হ্রদের তলদেশ ভরাট হতে হতে প্রতিবছরই পুরনো চরগুলোর সঙ্গে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন চর। সংকুচিত হয়ে আসছে প্রতিটি নৌ রুট। ফলে, বাঘাইছড়ি, বরকল, লংগদু, নানিয়ারচর, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি উপজেলার সঙ্গে সংযুক্ত ছয়টি নৌ রুট সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। এতে করে লাখো মানুষের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে।
কাপ্তাই হ্রদের টুরিস্ট বোটের চালক মো. সোহেল বলেছেন, পানি শুকানোর কারণে আমাদের বোট চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কাপ্তাই লেকে যাত্রাপথে টুরিস্ট নিয়ে খুবই সমস্যায় পড়তে হয়। চরে বোট আটকে গেলে পানিতে নেমে ধাক্কা দিতে হয়। লেকে পানি কমে যাওয়ায় আগের মতো টুরিস্টও আসছে না।
পরিবেশ বিপর্যয়, নির্বিচারে বন উজার, নাব্য সংকট ও অনাবৃষ্টির কারণে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ কাপ্তাই। পার্বত্য রাঙামাটির দুর্গম উপজেলাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ সহজ করা, অর্থনীতিতে গতি ফেরানো, মৎস্য সম্পদ আহরণ ও বাজারজাতকরণ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে কৃত্রিমভাবে কাপ্তাই হ্রদ তৈরি করা হলেও দীর্ঘদিন ধরে প্রতি গ্রীষ্ম মৌসুমে স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য এটি দুঃখ আর দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাঙামাটির লঞ্চ কর্মচারী মো. হৃদয় খান বলেন, কাপ্তাই লেকের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় রাঙামাটির বিভিন্ন উপজেলায় লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে হ্রদে ড্রেজিং না করায় প্রতি বছর এসব উপজেলার মানুষ অনেক কষ্টের মুখোমুখি হন। লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরাও চরম অর্থ সঙ্কটে আছি।
গ্রীষ্মে পানিস্বল্পতায় কাপ্তাই হ্রদের ছয়টি নৌ রুট বন্ধ, মাছ আহরণ বন্ধ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্ভোগে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন। থমকে আছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।
রাঙামাটি লঞ্চ শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি বিশ্বজিৎ দে বলেন, কাপ্তাই হ্রদে লঞ্চ চলাচল বন্ধ হওয়ায় আমাদের প্রায় ৩০০ শ্রমিক বেকার হয়ে গেছে। প্রতি বছর ৪-৫ মাস আমাদের এই লঞ্চ শ্রমিকদেরকে পরিবার-পরিজন নিয়ে আর্থিক সঙ্কটে দিনাতিপাত করতে হয়।
তিনি বলেন, হ্রদের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন স্থানে চর জেগেছে। সেখানে লঞ্চ আটকে যায়। আগে যেখানে ৩-৪ ঘণ্টায় লঞ্চ বিভিন্ন উপজেলায় পৌঁছে যেত, এখন সেখানে ৫-৬ ঘণ্টার বেশি সময় লাগে।
বিশ্বজিৎ দে বলেন, আমরা শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে সরকারের উচ্চ মহল এবং স্থানীয় সংসদ সদস্যদের বলেছি কাপ্তাই হ্রদে ড্রেজিং করার জন্য।
রাঙামাটির বরকল উপজেলার হরিণা বাজারের ব্যবসায়ী কাজল বিশ্বাস বলেন, আমি লঞ্চে করে হরিণায় মালামাল নিয়ে যাই। কিন্তু, লেকের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় আমাদের খুবই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। স্বাভাবিক সময়ে, একটা চালের বস্তা লঞ্চে করে নিতে যেখানে আগে লাগত ১০০ টাকা, এখন সেখানে আমার খরচ হচ্ছে ১৫০ টাকা। পানি শুকানোর কারণে বেশিরভাগ সময় বোট পাওয়ায় যায় না। হ্রদে বিভিন্ন জায়গায় চর উঠেছে। তাই, ব্যবসায়ীদের খুবই কষ্ট হচ্ছে। আমি সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, এই কাপ্তাই হ্রদে অতি শিগগির ড্রেজিং করা হোক।
রাঙামাটির রিজার্ভ বাজার এলাকার বাসিন্দা মো. আবু আলম বলেন, কাপ্তাই হ্রদের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় যাতায়াতের অসুবিধা হচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হচ্ছে। কেউ যদি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাকে পার্শ্ববর্তী জেলা দিয়ে রাঙামাটিতে নিয়ে যেতে হয়। প্রতিবছরই শুনি ড্রেজিং হবে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
রাঙামাটি লঞ্চ মালিক সমিতির সভাপতি মঈন উদ্দিন সেলিম বলেন, রাঙামাটির ছয়টি উপজেলার মধ্যে কাপ্তাই হ্রদ দিয়ে লঞ্চ দিয়ে পণ্য পরিবহণ হয়ে থাকে। বর্তমান শুকনো মৌসুমে কাপ্তাই হ্রদে পানি নেই বললে চলে। দীর্ঘদিন ধরে কাপ্তাই হ্রদে ডেজিং করার জন্য বলে আসছি। লেকের তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। আমরা চাই, ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে কাপ্তাই লেক আগের অবস্থায় ফিরে আসুক।
রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খাঁন বলেছেন, কাপ্তাই হ্রদে ড্রেজিং করার জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছি। এটি নিয়ে এখানকার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর সাথে কথা বলেছি। এখানে একটি ডিপিপি প্রণয়ন করা হয়েছে। নির্বাহী প্রকৌশলী জানিয়েছেন, কাপ্তাই হ্রদের যেসব পয়েন্টে পানি কমেছে, সেসব জায়গায় পানি যাতে সব সময় থাকে তার ব্যবস্থা করা হবে।