নিজস্ব প্রতিবেদক : ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারকে ভারত নিয়ে হত্যা, এর পরিকল্পনা, পেছনে কারা এবং এর সরাসরি যারা জড়িত তাদের রোমহর্ষক বর্ণনা পেলেও; কী কারণে জঘন্য এই হত্যাকাণ্ড, তা এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি তদন্তসংশ্লিষ্টরা। হত্যায় জড়িতদের শনাক্ত করার পাশাপাশি ৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও খুনের মূল রহস্য এখনো জানা যায়নি।
গত ২২ মে কলকাতায় সাঞ্জিভা গার্ডেন্সে ভারতের সিআইডি আনুষ্ঠানিকভাবে এমপি আনারকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করে। এরপর ২৮ মে ওই ফ্ল্যাটের সেপটিক ট্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে চার কেজির মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাংস ও হাড়ের গুড়ো এবং চুল উদ্ধার হওয়ার একটা ভিডিও ক্লিপ গণমাধ্যমের সামনে আনা হয়। মাংস উদ্ধারের কথা সিআইডি-ডিবি আনুষ্ঠানিকভাবে জানালেও ওই মাংস যে এমপি আনারের সেটা ফরেনসিক না হওয়া পর্যন্ত কেউ নিশ্চিত করেনি।
তবে ডিবি ধারণা করছে, ওই মাংসগুলো এমপি আনারেরই। তবে, ভারতের সিআইডি এ নিয়ে কোনও আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেনি। এসব নিয়ে এমপি আনারের পরিবার ও এলাকায় শুরু হয়েছে নানা রকম জল্পনা।
নিহতের মেয়ে মোমতারিন ফেরদৌস ডরিন বলেছেন, যদিও দাবি করা হচ্ছে কলকাতার সঞ্জিবা গার্ডেন থেকে আনোয়ারুল আজিমের মাংসপিণ্ড ও হাড়গোড় উদ্ধার করা হয়েছে। সেটা যে আমার বাবার, এখনও আমরা মেনে নিতে পারছি না। ডিএনএ পরীক্ষার পরই মেনে নেব, এটা আমার বাবার মরদেহের অংশ কি না। আমার বাবাকে কেন মারা হলো, তা এখনও আমি নিশ্চিত নই। বাবা কখনও কিছু জানাননি। তারপরও যদি বাবা খুনের শিকার হয়ে থাকেন, তাহলে কী কারণে করা হয়েছে— তাও তদন্ত করে বের করা হোক। কেননা ব্যবসায়ীক কারণে এ হত্যাকাণ্ড হতে পারে না। এর পেছনে রাজনৈতিক কিংবা অন্য কোনও কারণ থাকতে পারে, যা তদন্তের মাধ্যমে বের করতে হবে। কোনও ব্যবসায়ীক দ্বন্দ্বে আমার বাবা এ ধরনের খুনের শিকার হবেন, তা কোনওভাবেই মেনে নিতে পারছি না। শুধু আসামি গ্রেপ্তার বা তাদের রিমান্ডে নিলেই হবে না, পাশাপাশি যেসব সন্দেহভাজন আসামি বিশেষ করে যারা নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে, তাদের গ্রেপ্তার করে খুনের প্রকৃত কারণ বের করা হোক।
পুলিশ বলছে, এমপি আনার হত্যার ‘হোতা’ তার বাল্যবন্ধু ও ঝিনাইদহের যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী আখতারুজ্জামান ওরফে শাহিন মিয়া। আর হত্যাকাণ্ডটি বাস্তবায়ন করেছেন চরমপন্থি নেতা আমানুল্লা ওরফে শিমুল। আনার কলকাতায় যাওয়ার পরদিন বৈঠক করার জন্য নিউ টাউনে আখতারুজ্জামান শাহিনের ভাড়া বাসায় যান। সেখানেই আসামিরা তাকে হত্যা করে।
এদিকে, এ মামলার তদন্তের অংশ হিসেবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন-অর-রশিদ নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে অবস্থান করছেন। যাওয়ার আগে তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, আমরা এ হত্যাকাণ্ডের আসামি গ্রেপ্তার, পলাতকদের কীভাবে দেশে আনা যায়; একইসঙ্গে মরদেহের খণ্ডিত অংশগুলো উদ্ধারে চেষ্টা করে যাব। এ কারণে হত্যার প্রকৃত কারণ কী, তা নিয়ে এখনও আমরা তদন্ত শুরু করতে পারিনি। তবে, গ্রেপ্তারকৃত আসামিরা হত্যার পেছনে কারণ হিসেবে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। যেগুলোর যাচাই-বাছাই চলছে। নানা কারণ হত্যাকাণ্ডের পেছনে কাজ করলেও, এখনই নিশ্চিত করে কিছুই বলা যাচ্ছে না।’
বিভিন্ন সূত্রে আলাপ করে জানা গেছে, ব্যবসায়ীক লেনদেন বিষয়ে এমপি আনারের ওপর তার বন্ধু ও হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী আখতারুজ্জামান শাহিনের ক্ষোভ ছিল। এ ছাড়া, গ্রেপ্তার আসামি শিমুল ভূঁইয়া ওরফে শিহাব ওরফে ফজল মোহাম্মদ ভূঁইয়া ওরফে আমানুল্লা সাইদের সঙ্গে মতাদর্শের পার্থক্য ছিল আনারের। তারা-ই পরিকল্পনা করে আনারকে দেশের বাইরে হত্যা করতে কলকাতায় নিয়ে যায়। তবে, হত্যাকাণ্ডের ধরন দেখে তদন্তসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, পরিপূর্ণ তদন্ত শেষ করতে হলে এমপির ব্যক্তিগত, পারিবারিক, পারিপার্শ্বিক, ব্যবসায়ীক দ্বন্দ্ব, রাজনীতিক প্রতিহিংসাও এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে কাজ করতে পারে। সেভাবে তদন্ত করা হচ্ছে। এজন্য গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের তথ্যের পাশাপাশি তদন্তে ডিজিটাল প্রযুক্তিও ব্যবহার করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, এমপি আনারকে হত্যা করার আগে কলকাতার সেই ফ্ল্যাটে ওঠেন ডিবির কাছে গ্রেপ্তারকৃত শিলাস্তি রহমান। দায়িত্ব ছিল এমপি আনার যখন ফ্ল্যাটে আসবেন, তাকে রিসিভ করার। শিলাস্তি এমপি আনারকে রিসিভ করেন। এরপর থেকে আর আনারকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের ওয়ারী জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘গ্রেপ্তার শিমুল ভূঁইয়া জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, সে নিষিদ্ধ ঘোষিত পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) শীর্ষস্থানীয় নেতা। খুলনা, ঝিনাইদহ, যশোরসহ দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে তথা দেশের দক্ষিণাঞ্চলে তাদের নিষিদ্ধ দলের কার্যক্রম পরিচালনা করে। শিমুল দীর্ঘদিন ধরে এমপি আনারের আদর্শের বিরোধ ছিল। এ ছাড়া, ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী আখতারুজ্জামান ওরফে শাহিনের সঙ্গেও আনারের বিরোধ ছিল। গত জানুয়ারি ও মার্চ মাসে দুইবার এমপি আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করে তারা ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে শাহিন ভারতের কলকাতার নিউটাউন অভিজাত এলাকায় চলতি বছরের ২৫ এপ্রিল একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়। হত্যা পরিকল্পনার মিটিং করতে শাহিন ১০ এপ্রিল বাংলাদেশে চলে আসেন। পরবর্তীতে শিমুল ভূঁইয়া ও শাহিনের পরামর্শে অন্যান্য আসামিরা এমপিকে সুকৌশলে ব্যবসার কথা বলে কলকাতার ওই ফ্ল্যাটে নিয়ে যায়। পরে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী শিমুল ভূঁইয়াসহ অন্যান্য আসামিদের সহায়তায় এমপিকে হত্যা করা হয়।
গ্রেপ্তার শিমুল পুলিশকে জানিয়েছে, এমপি আনারকে হত্যা করা ও লাশ থেকে হাড়-মাংস আলাদা করার কাজে আসামি ফয়সাল, মোস্তাফিজ ও জিহাদ সরাসরি জড়িত ছিল। হাড় ও শরীরের অন্যান্য অংশ দূরে ফেলে দেওয়ার কাজে সিয়ামসহ অজ্ঞাতনামা ২/১ জন জড়িত ছিল।
এর আগে, গত ১২ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যান এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার। সেদিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে কলকাতায় তার পারিবারিক বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করতে যান। পরের দিন ১৩ মে চিকিৎসক দেখাতে হবে জানিয়ে দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে গোপালের বাড়ি থেকে বের হন আনার। সন্ধ্যায় ফিরবেন বলেও জানান তিনি। পরে বিধান পার্কের কাছে কলকাতা পাবলিক স্কুলের সামনে থেকে ট্যাক্সিতে উঠেছিলেন তিনি। চলে যাওয়ার পর সন্ধ্যায় আজিম তার বন্ধু গোপালকে জানান, তিনি দিল্লি যাচ্ছেন এবং সেখানে পৌঁছে তাকে ফোন করবেন। পরে তার সঙ্গে ভিআইপিরা আছেন জানিয়ে বন্ধু গোপালকে ফোন না দেওয়ার জন্য সতর্ক করেছিলেন।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মো. হাবিবুর রহমান বলেন, হত্যাকাণ্ডের ‘মূল পরিকল্পনাকারী’ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আখতারুজ্জামান শাহিনকে গ্রেপ্তার করা গেলে আসল কারণ জানা যাবে বলে মনে করি। কী কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে, অর্থাৎ এই হত্যার মোটিভ কী, তা বাংলাদেশের পুলিশ বা ভারতের পুলিশ কেউই উদঘাটন করতে পারেনি। কারণ, এর যে মূল পরিকল্পনাকারী (আখতারুজ্জামান শাহিন) তিনি এখন দেশের বাইরে রয়েছেন, তাকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। তাকে গ্রেপ্তার করলেই কেবল এই হত্যার মোটিভ জানা সম্ভব হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দিবিনিময় চুক্তি নেই। সেক্ষেত্রে পলাতক আসামিকে ফেরত আনতে পুলিশের উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে হাবিবুর রহমান বলেন, এক্ষেত্রে যে ধরনের প্রচেষ্টা করা দরকার সেটির সর্বোত্তম চেষ্টা করা হবে পুলিশের পক্ষ থেকে। যেহেতু তিনি (আনার) আমাদের সংসদ সদস্য ছিলেন, সুতরাং তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে। যদিও তাদের সঙ্গে (আমেরিকা) আমাদের সেই ধরনের চুক্তি নেই। অন্য যে কোনও মাধ্যম বা কূটনৈতিক চ্যানেলে সর্বোচ্চ চেষ্টা এ বিষয়ে করা হবে।