জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক : আওয়ামী লীগ সরকার আমলে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণ করে গত দেড় বছরে ২৪ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য করে ২০ হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। চক্রের হোতা হিসেবে নাম উঠে এসেছে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালসহ প্রভাবশালী সাবেক চার এমপির। তারাই মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং সিন্ডিকেট তৈরি করে হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছেন।
বাকি তিন হলেন— ফেনী–২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী, ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, ঢাকা-২০ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বেনজীর আহমেদ। তাদের মধ্যে তিনজন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও একজন জাতীয় পার্টির।
জানা গেছে, দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিদেশে পাচারের অভিযোগে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। ইতোমধ্যে অনুসন্ধানকারী টিম নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ফলে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার হাতিয়ে নেওয়া কাণ্ডে ফেঁসে যাচ্ছেন সাবেক এই চার এমপি।
রোববার (১৮ আগস্ট) দুদকের ডেপুটি ডিরেক্টর আকতারুল ইসলাম জানায়, সাবেক চার এমপির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের জন্য দুদকের উপপরিচালক মোহাম্মদ নুরুল হুদার নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ খরচ ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা। কিন্তু মালয়েশিয়া যেতে গড়ে একজন বাংলাদেশি কর্মী খরচ করেছেন ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। দেড় বছরে সাড়ে চার লাখের মতো কর্মী পাঠিয়ে ২৪ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে এ খাতে। সরকার নির্ধারিত ফি’র চেয়ে বেশি নেওয়া হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ‘চক্র ফি’ নেওয়া হয়েছে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি।
জানা যায়, ফেনী–২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী বিদেশে কর্মী পাঠাতে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে স্নিগ্ধা ওভারসিজ লিমিটেড নামে রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স নেন। এরপর সাড়ে তিন বছরে মাত্র ১০০ কর্মী বিদেশে পাঠায় স্নিগ্ধা। মালয়েশিয়া সিন্ডিকেট বা চক্রে যোগ দেওয়ার পর দেড় বছরে প্রায় ৮ হাজার কর্মী গেছেন নিজাম হাজারীর এজেন্সির নামে।
ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী ২০১৫ সালে ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনাল নামে রিক্রুটিং এজেন্সি করেন। মালয়েশিয়ায় এককভাবে শ্রমিক পাঠানোর শীর্ষে রয়েছে ফাইভ এম। প্রতিষ্ঠার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে আড়াই হাজারের মতো কর্মী পাঠালেও মালয়েশিয়ায় পাঠিয়েছে ৮ হাজার ৫৯২ কর্মী।
ঢাকা-২০ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বেনজীর আহমেদের প্রতিষ্ঠান আহমেদ ইন্টারন্যাশনাল মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর দিক থেকে পঞ্চম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান। মালয়েশিয়া শ্রমবাজার চালুর আগে তাদের তেমন কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না। বিদেশে পাঠিয়েছিল মাত্র ২৩৮ কর্মী। তবে, মালয়েশিয়া চক্রে ঢুকে তারা শীর্ষ তালিকায় চলে যায়। প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে মালয়েশিয়া গেছেন ৭ হাজার ৮৪৯ কর্মী। চক্র গঠনের সময় বেনজীর ছিলেন রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার সভাপতি।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামালের স্ত্রী কাশমেরী কামালের অরবিটালস এন্টারপ্রাইজ ও মেয়ে নাফিসা কামালের অরবিটালস ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে মালয়েশিয়া গেছেন মোট ৯ হাজার ৮৬১ জন। চক্র গঠনের সময় তিনি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। চক্রের অন্যতম হোতা সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামালের স্ত্রী কাশমেরী কামালের নামে, অন্যটি মেয়ে নাফিসা কামালের নামে।
অভিযোগ রয়েছে, সাবেক চার সংসদ সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যের এজেন্সির পাশাপাশি আ.লীগ নেতা, সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর এবং এ-খাতের নতুন অনেক প্রতিষ্ঠান বিপুল সংখ্যক কর্মী পাঠাচ্ছে। বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশ মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠায়।
তবে, বাংলাদেশ ছাড়া কোনও দেশে এমন চক্র-ব্যবস্থা নেই। চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও জড়িত। চক্রে থাকা এজেন্সিগুলো বসে বসে প্রতি কর্মীর বিপরীতে অন্তত দেড় লাখ টাকা ‘চক্র ফি’ পাচ্ছে। অন্যান্য এজেন্সির মধ্যে অন্যতম হলো— ঐশী ইন্টারন্যাশনাল, নিউ এজ ইন্টারন্যাশনাল, ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল, বিএনএস ওভারসিজ লিমিটেড, পিআর ওভারসিজ, সাদিয়া ইন্টারন্যাশনাল, ইম্পেরিয়াল ওভারসিজ, বিএম ট্রাভেলস লিমিটেড এবং অনন্য অপূর্ব রিক্রুটিং এজেন্সি।
উল্লেখ্য, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর থেকে তারা সবাই আত্মগোপনে আছেন। এর মধ্যে আ হ ম মুস্তাফা কামাল সিঙ্গাপুরে বলে জানা গেছে।